আপনি কি লগআউট করতে চান

হৃদয় যন্ত্রণা হলে মরে যেতে ইচ্ছে করে, শরীরে যন্ত্রণা হলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। দুটোই যন্ত্রণা, স্থান ভেদে ইচ্ছেরা ভিন্নতর কেন হয়? প্রচন্ড দাঁত ব্যথা নিয়ে শিহাব এই সব কথা ভাবছে আর বেঁচে থাকার ও মরে যাওয়ার তফাৎ মিলাচ্ছে।

শিহাব এখন মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। কৈশোর পেরিয়ে কেবল যুবক হয়ে উঠছে। বলা চলে কৈশোর ও যুবকের সন্ধিক্ষণ। এ বয়সে বন্ধুর বোনের প্রেমে পড়ে নি এমন বাঙ্গালী ছেলে পাওয়া দুষ্কর। এবং এটি একটি দুষ্কর্মও বটে। ইরার সাথে সেই দুষ্কর্ম টি করেছে শিহাব।

ইরার পুরো নাম তাসনিম তাবাসসুম ইরাবতী। বাড়ীর সবাই এমনকি পাড়ার ও স্কুল বন্ধুরা ওকে ইরা বলেই ডাকে। শিহাবও ওকে সেই নামে চেনে। বন্ধুর ছোট বোন বলে শিহাব ওকে যথেষ্ট স্নেন করে। ইরাও ওকে শিহাব ভাইয়া শিহাব ভাইয়া বলেই ডাকে। ইরা বেশ চঞ্চল ও উচ্ছল। সদ্য এসএসসি পরিক্ষা দেয়া মেয়েরা যেমন হয় তার থেকে কিছুটা বেশী। কারণে অকারণে ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি মধুর আবদার করে শিহাবের কাছে। শিহাবও ইরার আবদার রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে। বন্ধুর ছোট বোন বলে কথা। পাশাপাশি মহল্লায় ওদের বাস। খুব কাছের বন্ধুর ছোট বোন বলে শিহাবের সাথে ইরার প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হয়। মহল্লায় অথবা ইরাদের বাসায়। দেখা হলেই ইরা চঞ্চল হয়ে ওঠে শিহাব সেটা লক্ষ্য করেছে তবে আমলে নেয়নি। এমনি এক সাধারণ সময়ের সূর্য ডোবার আগের কথা। শিহাব ক্রিকেট প্রাকটিস শেষে বাড়ী ফিরছে। গলির মোড়েই ইরা ও তাঁর কয়েক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে যায়। ইরা স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা নিয়ে শিহাবকে বলে; শিহাব ভাইয়া আমাদের আইসক্রিম খাওয়াবে, প্লিজ। শিহাব কিছুটা অবাক ও বিস্ময় নিয়ে যদিও বলে; এই শীতের সন্ধ্যায় তোরা আইসক্রিম খাবি? কিন্তু ইরার আবদারের কাছে ও পরাজিত হয় বরাবরের মত। ভাবা যায়, মাঘ মাসের শীতের সন্ধ্যায় কৈশোর ও যুবকের সন্ধিক্ষণে থাকা একটি ছেলে দোকানের ডিপ ফ্রিজ থেকে কয়েকটি কিশোরীকে আইসক্রিম তুলে তুলে দিচ্ছে আর বলছে; আইসক্রিম খাও ভাল কথা কিন্তু ঠান্ডা বা জ্বর হলে আমি কিন্তু কোন দায় নিতে পারবোনা।

এই পর্যন্ত শিহাব ও ইরার সম্পর্কে আমি তেমন কোন প্রেম আমি খুঁজে পাইনি। যদিও ইরা বিষয়টা শিহাব কে বলতে চেয়েছে বা বুঝাতে চেষ্টা করেছে। বারবার নিজ হাতের চা বানিয়ে খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়েছে এবং শিহাবও বিষয়টা বুজেছে তবে তাঁকে বলেছে- তুই আমার বন্ধুর ছোট বোন। তোর হাতের চা না খেলেও আমার চলবে। এমন ভাবনা আর যেন মাথায় না আসে। কিন্ত কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে গতকাল। শিহাব যখন ইরাদের বাসায় যায় তখন ইরা ওকে বলে- ইমন ভাইয়া তো বাসায় নেই। শিহাব বলে- সে আমি জানি। তুই ইমনের রুমে যা, ওখানে একটা ব্যাট রাখা আছে নিয়ে আয়। আমি প্রাকটিসে যাব, ওরা অপেক্ষা করছে। ইরা তখন বলে আমার এই কাগজ গুলো ফটোকপি করাতে হবে, তুমি কি করিয়ে আনবে প্লিজ। আমি তোমাকে নিজ হাতে বানানো চা খাওয়াবো। শিহাব বলে- তোর বানানো চা আমার খাওয়া লাগবে না। তুই ব্যাটটা নিয়ে আয়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ শিহাব ভাইয়া - বলেই ইরার হাতের ফাইলটা শিহাবকে ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়। শিহাব কোন উপায় না দেখে ফাইলটা নিয়ে দোকানে যায়। দোকানে গিয়ে ফটোকপি করাতে থাকে। হঠাৎ একটা এ্যাডমিটকার্ডের উপর চোখ পরে, তাতে নামের স্থানে লেখা- তাসনিম তাবাসসুম ইরাবতী। শিহাব ফিরে এসে দেখে লনের সামনে ইরা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। দেয়ালের সাথে ব্যাটটা হেলান দিয়ে রাখা। শিহাব ফাইলটা ইরাকে ধরিয়ে দিয়ে ব্যাট নিয়ে চলে আসবে এমন সময় ইরা বলে- সরি, আমি তোমাকে আর অমন কথা বলবো না। শিহাব বলে- ঠিক তো। ইরার একহাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে ফাইল, মাথা নিচু করে করে বলে- বিদ্যা আর বলবো না। বলেই চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয়। শিহাব চায়ের কাপ নিতে নিতে বলে- তাসনিম তাবাসসুম ইরাবতীটা কে-রে? অমনি ইরা চপলা হয়ে ওঠে। বলে-ও মা তুমি জান না, ওটা তো আমার নাম। তাসনিম তাবাসসুম ইরাবতী। এই প্রথম শিহাব জানতে পারে ইরার পুরো নাম তাসনিম তাবাসসুম ইরাবতী। ইরা বলতে থাকে- সিন্ধু নদী হয়ে আরব সাগরে পতিত হওয়া ৭২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক নদী আছে। সেই নদীর নাম ইরাবতী। বাবা সেই নামেই আমার নাম রাখে ইরাবতী। ইরাবতী থেকে ইরা। ইরা মন রাখাপ করে বলে-ইস আমার জীবনটা যদি নদীটার মতই হতো তাহলে কাউকে আর জ্বালাতাম না। বলেই চুপ হয়ে যায়। শিহাবের প্রেমে পরার বিষয়টি ঘটে এখানেই। ইরাবতীর চুপ হয়ে যাওয়াতে। বন্ধুর ছোট বোন বলে ইরার প্রেমে পরা নিয়ে কিছুটা সংশয় শিহাবের মনে থাকলেও ইরাবতীর প্রেমে পরা নিয়ে কোন সংশয় ওকে আটকাতে পারেনি।

শিহাব দাঁতের ব্যথায় বাসায় বন্দী। কলেজ, প্রাকটিস সব বন্ধ। এর মধ্যে আবার নাজমা আপার বিয়ে। নাজমা আপা মহল্লার এক বড় বোন। বেশ স্মার্ট ও মেধাবী। মেয়েরা বেশী মেধাবী হলে ডাক্তার হয় আর নাজমা আপা হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করছে এক ডাক্তারকে। ডেন্টাল ডাক্তার, প্রেমের বিয়ে। ডাক্তার পাত্র নিয়ামুল আবার ইরাদের কাজিন। সেই বিয়েতে শিহাবকে হাজির থাকতেই হবে, দাঁতের যতই যন্ত্রণা হোক। নাজমা আপা ফোনে শিহাবকে আল্টিমেটাম দিয়েছে এবং বলেছে; দাঁতের ব্যথার উছিলায় তুই যদি আমার বিয়েতে না আসিস তবে মনে রাখিস আমার বাসর রাত হবে ডেন্টাল হাসপাতালে। নিয়ামুলকে দিয়ে তোর মুখের সব দাঁত তুলে ফেলেই আমি বাড়ী ফিরবো। শিহাব মৃদু স্বরে বলে আমি তো বলেছি; তোমার বিয়েতে আমি কব্জি ডুবিয়েই খাব। সেই বিয়েতে শিহাব তীব্র দাঁতের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে উপস্থিত হয়েছে। ওর ডান গালটা ফোলা ফোলা। ইরাও যে এই বিয়েতে আসবে সেটা ও জেনেছে ইরার থেকেই। নাজমা আপার ফোন রাখতে রাখতেই ইরার ফোন; শিহাব ভাইয়া, তোমার নাকি আক্কেল দাঁত উঠেছে? বলেই সে কি হাসি ইরার। শিহাব দাঁতের ব্যথায় কিছু বলতে পারছে না আবার হাসতেও পারছে না। শিহাব চুপ। ওপাশ থেকে ইরা বলে- শিহাব ভাইয়া, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? ইরার গলা শান্ত। শিহাবের বুকটা চিন চিন করে ওঠে। কিশোরী ইরাবতীর শান্ত গলা শিহাবের শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দেয়।

বিয়ে বাড়ী গমগম করছে। এখনকার পার্টি সেন্টারগুলো শীততাপনিয়ন্ত্রিত। শব্দ বেরোনোর কোন পথ নেই। ইকো সিস্টেমের কোন ব্যবস্থা থাকার কথাও না। তাই সদা গমগম করে। শিহাব এত শব্দ নিতে পারছে না, এক কোনে ইকটু নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁতের ব্যথা ক্রমশঃ কানের দিকে যাচ্ছে। শিহাব ব্যথা চলাচলের বিষয়টা ফিল করার চেষ্টা করছে। এত কোলাহলে বিষয়টা ঠিকঠাক ফিল করতে পারছে না শিহাব। দাঁতের ব্যথার সাথে সাথে মনের মধ্যেও একটা ব্যথা টনটন করছে। শিহাব হঠাৎ ইরার কথা ভাবতে শুরু করে। ইরা কখন আসবে? শারীরিক যন্ত্রণা নাকি মনকে-ও দূর্বল করে দেয়। শিহাব বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে খেয়াল করে একটা পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে। বেশ পরিচিত ঘ্রাণ এবং বেশ কাছে। শিহাব মাথাটা ঘুরাতে গিয়ে দাঁতের ব্যথা টের পায়। সাথে সাথে শুনতে পায়; তোমার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে শিহাব ভাইয়া? শিহাব এবার ঘুরে তাকায়। দেখে অসম্ভব রূপবতী ইরাবতী। এই ইরাবতীকে সে কখনও দেখেনি। শিহাব অপলক তাকিয়ে আছে। অসম্ভব রূপবতী কন্যার চোখ ছলছল করছে। কিরে তুই কখন এলি? অসম্ভব রূপবতী কন্যার বাম চোখে শিশির বিন্দু জমেছে। ছোঁয়া পেলেই ঝড়ে যাবে। চোখের কাজল হয়তো কিছুটা বাঁধা হয়ে আছে। এত শব্দে তোমার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে? অজান্তেই ইরাবতীর অনামিকায় শিহাবের আঙ্গুলের ছোঁয়া লাগে। ইরাবতীর চোখের কাজলের বাঁধা দূর হয়ে যায়। শিশির বিন্দু গাল বেয়ে নেমে আসে। শিহাব অস্ফুট স্বরে বলে -ইরাবতী তুই কাঁদছিস কেন? আজ আমার খুব মন খারাপ বলেই ইরাবতী শিহাবের হাতটা চেপে ধরে। দু'জন বিশাল পার্টি সেন্টারে এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পার্টি সেন্টারের কোন শব্দ শোনা যায় না শুধুই দু'জনার হার্টবিট শুনতে পায় দু'জন।

এ এক অন্যরকম যন্ত্রণা। দাঁতের ব্যথায় শরীর কাতর আর ইরাবতীর প্রেমে হৃদয় কাতর। ইরাবতীর প্রেমে পরার প্রথম রাত শিহাব ঘুমোতে পারে না। ইরা কেন এত চঞ্চল? ইরা কেন এত উচ্ছল? সেই রহস্য আবিষ্কারের আনন্দ ও বন্ধুর ছোট বোনের প্রেমে পরার সংশয় শিহাবকে কিছুতেই ঘুমোতে দিচ্ছে না। শিহাবের মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

সগীর মোস্তফা

২৫ আগস্ট ২০২৫

© ২০২৪ লেখারপোকা | সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত

ট্রেড লাইসেন্স ঃ TRAD/DSCC/217680/2019